করোনার অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে হবে-আহসান এইচ মনসুর

করোনাভাইরাস

করোনার অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে হবে

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ ২০২০,২৮ ফাল্গুন ১৪২৬

আহসান এইচ মনসুর

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পর গত তিন মাসে প্রায় একশ’টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে সোয়া লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে চার হাজারের অধিক মানুষের। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশও এই ভাইরাসের নানাবিধ ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। ইতোমধ্যে এখানেও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মানুষের মৃত্যু বা আক্রান্তের হারই যে শুধু বাড়ছে তা নয়, এর অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে। অনেক দেশের বিমান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে বৈশ্বিকভাবে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে।
করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বকে সার্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলেছে। এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। আবার দুই-একটা ইতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। নেতিবাচক প্রভাবগুলো আমরা জানি যে, বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক যোগাযোগ ও পর্যটন শিল্পেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কারণ, বাংলাদেশ গার্মেন্টসসহ অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে চীন থেকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, চীন থেকে যদি সারাবিশ্বে কাঁচামাল রপ্তানি ২ শতাংশও কমে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে ক্ষতি হবে এক কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি কত শতাংশ কমবে, তা জানি না; কিন্তু পতনের পরিমাণগতভাবে ২ শতাংশের আরও অনেক বেশি হবে বলে মনে করি।
গত এক দশকে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রাবন্দরসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে কাজ করছেন চীনের নাগরিকরা। সব মিলিয়ে এ দেশে চীনের প্রায় ১০ হাজার নাগরিক বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত চীনের নাগরিকদের আপাতত নিজ দেশে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যারা নববর্ষ উদযাপনে দেশে গেছেন, তাদের আপাতত না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আর যারা একান্ত প্রয়োজনে চীন থেকে আসছেন, তাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে সব ধরনের শিল্প ও প্রকল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আগামীতে এই প্রভাব আরও বেশি হতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। তার সঙ্গে আমাদের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ আরও পতন হচ্ছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।

চীনের পর সবচেয়ে বেশি অবস্থা বিরাজ করছে ইতালিতে। এছাড়া, ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশে দ্রুতই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। এসব দেশে যদি করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে সেখানকার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কমে যাবে বহুলাংশে। চাহিদা কমে গেলে অর্ডারগুলো বাতিল হতে পারে।
করোনাভাইরাসের কারণে পেট্রোলিয়ামের বাজার এমনিতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি চীনে চাহিদা কমে যাওয়ায় সংকট শুরু হয়েছিল। তারপর একের পর এক দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ এড়াতে ইতোমধ্যে অনেক উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। ফলে তেলের চাহিদা কমায় বৈশ্বিক বাজারে দাম কমেছে, যা আমাদের জন্য অবশ্য তুষ্টির বিষয়। এটা আমাদের জন্য সহায়ক হবে। কারণ, আমরা জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আবার বিশ্ব মুদ্রাবাজারের ওপরও করোনাভাইরাস ও পেট্রোলিয়ামের মূল্য হ্রাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য জাপানের ইয়েনের তুলনায় আচমকা কমে গেছে। বিশ্বের অনেক শিল্পোন্নত দেশে করোনাভাইরাসের জের ধরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকসান ও সংকটের আশঙ্কা বেড়ে চলেছে। আপাতত করোনা মোকাবিলা নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকলেও নেপথ্যের এই অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে আর তেমন কোনো সন্দেহ নেই। বিভিন্ন দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সেসব উদ্যোগ ক্ষতির মাত্রা কতটা সামাল দিতে পারবে, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
তবে বিশ্ব বাণিজ্যিক খাত থেকে যে পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হতে পারে, যদি আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে রাখতে না পারি। বাংলাদেশে যদি ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধ করা যায়, তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজার সচল থাকবে। আর সংক্রমণ রোধ করা না গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে আসবে। তখন অবস্থা বেশি খারাপের দিকে যাবে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার অবকাশ থাকবে না। যতদূর সম্ভব দেশকে করোনার প্রকোপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ বাজার, লেনদেন ও আর্থিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা সম্ভব হবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে যেতে হবে, যাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার ব্যাপক পতন না হয়।
নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

https://www.samakal.com/editorial-comments/article/200315135/

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...