নব্বই দশক ছিল বাণিজ্য নীতির স্বর্ণযুগ

নব্বই দশক ছিল বাণিজ্য নীতির স্বর্ণযুগ

ড. জাইদী সাত্তার

আগস্ট ৩১, ২০২১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। বিশ্লেষকরা গত পঞ্চাশ বছরে দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই বাংলাদেশের অবস্থা এমন ছিল না। তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায় বাংলাদেশ ছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১০০ ডলার, যা চাদ (Chad), রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও নেপালের কাছাকাছি। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলারের বেশি। মোট জিডিপির আকার ৩২৫ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির আকারের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ৪০টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ।

১৯৯০এর দশকে শুরু হওয়া ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা এখনো বজায় রয়েছে। করোনার প্রভাবে গত দুই দশকের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারে বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশ টানা দুই দশক ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক ৬-৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়াতে সহায়তা করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রভাবে দারিদ্র্য বিমোচনেও গতি এসেছে। অর্থনীতি এবং সমাজে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে।

উল্লেখযোগ্য রূপান্তরের প্রধান চালকগুলো কী? অবশ্যই এর পেছনে ইতিবাচক রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ছিল, যা রূপান্তর প্রক্রিয়ায় স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। কয়েক দশকজুড়ে আমাদের ধারাবাহিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূলে ছিল কয়েকটি এনজিও এবং সরকারের ব্যাপক কর্মতত্পরতা। দেশের মানব উন্নয়নে অগ্রগতির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। নিউইয়র্ক টাইমসের শীর্ষ কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ তো আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো বাংলাদেশের দৃঢ় ও দূরদর্শী সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে টেকসই সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় ভূমিকা রেখেছে বলে স্বীকার করেছে।

আমার মতে, আমাদের অর্থনৈতিক নীতির সাধারণ দিকনির্দেশনা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মৌলিক তত্ত্ব-মতবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। মূলত এটিই জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মজুবত ভিত রচনা করেছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালচিত্রের পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে নব্বইয়ের দশকের বাণিজ্য নীতির (বাজারমুখিতার সঙ্গে অ-নিয়ন্ত্রণ) মৌলিক পরিবর্তন বড় ভূমিকা রেখেছে বলে উঠে এসেছে। এখন এটি বলা সংগত যে বাংলাদেশ সঠিক ধারায় এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। আমার মূল্যায়ন হলো, বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের নির্দেশনা নীতি পরিসরের অন্য কোনো জায়গায় ছিল না। তথ্যে দেখা যায়, পরবর্তী দশকগুলোয় বাংলাদেশ ওইসব পরিবর্তনের সুফল ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। যেজন্য শীর্ষ অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান বাংলাদেশকে ‘ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স’ এবং ‘মিরাকল অন দ্য মেঘনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমার মতে, ১৯৯০-এর দশকে নেয়া অভ্যন্তরমুখী আমদানি প্রতিস্থাপন নীতির পরিবর্তে রফতানিমুখী বাণিজ্য নীতি ছিল বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জার।

১৯৭০-এর দশকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বাণিজ্য নীতি কখনো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। প্রাধিকার এজেন্ডা ছিল প্রধানত অভ্যন্তরীণ নীতি সমর্থনের মাধ্যমে বিদেশী সহায়তা (ডোনার অ্যাসিস্ট্যান্স) দিয়ে গণদারিদ্র্য নিরসন এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা। আদতে বাণিজ্য নীতিভিত্তিক অবস্থান ছিল অতীতেরই লিগ্যাসি—যেখানে উচ্চ শুল্ক এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি আর্থিক ও শিল্প করপোরেটদের জন্য একটি সুরক্ষিত বাজার (ক্যাপটিভ মার্কেট)। ফলে আমাদের অর্থনীতি অভ্যন্তরমুখী আমদানি প্রতিস্থাপনকারী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। অতি প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটাতে শূন্য বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের বাস্তবতায় লেনদেনের ভারসাম্যের সংকট এড়াতে উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণকেই সুবিধাজনক কৌশল হিসেবে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথমদিকে গ্রহণ করা হয়েছিল।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিশেষ বিধান (স্পেশাল ডিসপেনশন) প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শিল্প এবং বাণিজ্য নীতি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনবত্ব এসেছিল। তখন কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুবিধা দেয়া হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল রফতানি আয় থেকে আমদানি ব্যয় মেটাতে। এ সুবিধা গ্রহণ করে দেশ গার্মেন্টস (কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান দাইয়ুর সহযোগিতায় প্রভাবশালী এক আমলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন) মাল্টি-ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টসের (এমএফএ) অধীনে পশ্চিমা বাজারগুলোয় প্রবেশের জন্য শতভাগ রফতানিমুখী কারখানা চালু করেছিল। এভাবেই আজকের বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি শিল্পের উত্থান, যেটি শ্রমনিবিড় উৎপাদনে দেশের আপেক্ষিক সুবিধা সফলভাবে প্রয়োগ ঘটিয়েছে। বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এ শিল্পের মাধ্যমে, বিশেষ করে নারীর কর্মসংস্থান। বাকিটা ইতিহাস।

১৯৮০-এর দশকে বাণিজ্য নীতিতে তিনটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। এক. আমদানি প্রতিস্থাপন নীতি নিয়ে বড় ধরনের হতাশা-অসন্তোষ ছিল। সরকার দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিকাশের সহায়ক কৌশল হিসেবে আমদানি নিষিদ্ধ বা সীমিত করেছিল। তবে তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ কৌশল প্রতিযোগিতামূলক শিল্পায়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেনি, আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও খুব একটা সহায়তা করেনি। অন্যদিকে অসংখ্য অদক্ষ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটিয়ে সুরক্ষাবাদ নিজেই পাকাপোক্ত হয়েছে। ‘শিশু’ শিল্পগুলো প্রতিযোগিতামূলক হতে ব্যর্থ হয়েছে এবং টিকে থাকার জন্য তাদের অধিকতর সুরক্ষা দিতে হয়েছে। দুই. আমদানি প্রতিস্থাপন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন উন্নয়ন প্যারাডাইমের উত্থান ঘটেছিল, যাকে বলা হয় রফতানিচালিত প্রবৃদ্ধি। এ উন্নয়ন মডেলের মধ্য দিয়ে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো (বিশ্বব্যাংকের ভাষায় ইস্ট এশিয়ান মিরাকল) উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ১৯৮০-এর দশকে উন্নয়ন ডিসকোর্সে এ কৌশল সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করে নিতে পেরেছিল। তিন. ওয়াশিংটন কনসেনশাস (যেমন বাণিজ্য উদারীকরণে জোর দেয়া, মুক্তবাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা) যা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমোট করেছিল। ওই সময়ে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এবং অধিকাংশ পেশাজীবীর মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল।

দুঃখজনকভাবে এসব তাত্পর্যজনক উন্নয়ন কৌশল আমাদের তত্কালীন নীতিনির্ধারকদের দিক থেকে খুব একটা মনোযোগ লাভ করেনি। কাজেই বাংলাদেশে বাণিজ্য নীতি উন্নয়নের দিক থেকে ১৯৮০-এর দশক ছিল ব্যর্থ। ফলে তত্কালে বাণিজ্য নীতি উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে খুব কমই ভূমিকা রাখতে পেরেছে। উন্নয়ন কৌশলে বাণিজ্য নীতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে সে সময়ের সরকারগুলো কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোর তাগাদায় বাণিজ্য সম্পর্কিত পদক্ষেপগুলো নেয়া শুরু হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়ার শর্ত হিসেবে বাণিজ্যনীতির সংস্কারকে জুড়ে দিয়েছিল। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বাড়ানোর কোনো ধরনের পদক্ষেপ ছাড়াই বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি কিছু পণ্য আমদানিতে সীমিত রাখা হয়েছিল। একমাত্র উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল কৃষি উপকরণ (যেমন- বীজ, সার, যন্ত্রপাতি) আমদানিতে শুল্ক উদারীকরণ, যা অভ্যন্তরীণ কৃষি বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছিল। বস্তুত বাণিজ্য নীতি-কৌশল লেনদেন ভারসাম্য (বিওপি) পরিস্থিতির উন্নতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখেনি। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখেনি। পুরো ৮০-এর দশকে লেনদেন ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ফলে ১৯৯০ সালে বিওপি সংকট দেখা দেয়। রফতানিমুখী উন্নয়নের পথে যেতে বাংলাদেশ অনেকটা সময় নিয়েছে। অথচ রফতানিমুখী শিল্পের কারণে আমাদের পাশের পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উত্থান ঘটেছিল। বিষয়টি তত্কালে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণের কথা থাকলেও সেটি যথাযথভাবে প্রাধান্য পায়নি। সাধুবাদ যে পরবর্তী দশকে এক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে।

১৯৯০-এর দশক ছিল সত্যিকার অর্থেই বাণিজ্য নীতি উন্নয়নের স্বর্ণযুগ, যখন বাণিজ্য নীতি ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন হয়েছিল এবং যার শুরু দশকটির প্রারম্ভেই। ১৯৮০-এর দশকের ক্রান্তিকালে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অর্থনীতি বড় ঝাঁকুনির মুখে পড়েছিল। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল শ্লথ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের নিচে নেমে গিয়েছিল এবং লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মেলবন্ধন (এরশাদ শাসনের পতন এবং গণতন্ত্রের শুরু) মৌলিক সংস্কারের পথ তৈরি করেছিল। দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুপ্ত সম্ভাবনা জাগাতে বিদায়ী শাসন ব্যবস্থার রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্যের অবসান ঘটাতে হয়েছিল। ওই পরিস্থিতিতে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি, ঋণ এবং বাণিজ্য নীতিতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের বিপরীতে বিওপি সাপোর্ট দিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এগিয়ে এসেছিল। অতি প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল ওয়াশিংটন কনসেনশাসের আদলে আর্থিক রক্ষণশীলতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, বাজারমুখিতা ও বিনিয়োগের বি-নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারীকরণের মতো পদক্ষেপ। প্রকৃতপক্ষে এ সময়ে বাণিজ্য নীতির পরিবর্তনকে মৌলিক বলা যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে ছিল (১) শুল্কের যৌক্তিকীকরণ ও লক্ষণীয় মাত্রায় এর হার হ্রাস, (২) অবরোধ, পণ্যের পরিমাণগত নিষেধাজ্ঞা (কিউআর) ও আমদানি লাইসেন্সিং প্রত্যাহারের মাধ্যমে আমদানি উদারীকরণ, (৩) মুদ্রাবিনিময় ব্যবস্থা স্থির থেকে নমনীয় হারে স্থানান্তর এবং (৪) চলতি হিসাবের সীমিত বিনিময়যোগ্যতা। এ সময় নব্বইয়ের দশকের বাণিজ্য উদারীকরণ ছিল গভীর ও রূপান্তরমূলক। ২০০১ সালে প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের ওপর বাণিজ্য উদারীকরণের প্রভাববিষয়ক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উন্নয়নশীল বিশ্বে বাংলাদেশকে ‘গ্লোবালাইজারের’ তালিকায় রাখা হয়েছিল। অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত করা হয়েছিল যে এসব গ্লোবালাইজার দেশগুলো উচ্চ আয় প্রবৃদ্ধি এবং ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করতে পেরেছিল।

এ প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধানগুলো বাণিজ্য উন্মুক্ততার এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল, যা একুশ শতকের শুরুতে বাংলাদেশে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ত্বরান্বিত করেছিল। বাণিজ্য উদারীকরণের বিপরীতে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধির কৌশল অবশেষে নীতি পরিসরে পাকাপোক্তভাবে জায়গা পেয়েছিল। অসম্পূর্ণ হলেও ১৯৯০-এর দশকের সংস্কার রফতানিমুখী উৎপাদন প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরবর্তী দুই দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে যথেষ্ট গতিশীলতার সৃষ্টি করেছিল এবং তার রেশ এখনো চলমান। দেখা যায় দশকভিত্তিক গড় প্রবৃদ্ধি প্রতি দশকে ১ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপর বাড়তে শুরু করেছিল। ১৯৯১-২০০০ দশকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০১-২০১০ দশকে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০১১-১৯ দশকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২ শতাংশে। অন্যদিকে ১৯৯০-এর দশকে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৭ শতাংশ, যা ২০১০ সালে কমে (৩১ দশমিক ৫ শতাংশ) প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে আসে এবং হিসাব করা হয় যে ২০১৯ সালে তা নেমে আসে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিরই প্রমাণ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কভিড ১৯ মহামারীর অভিঘাত বাংলাদেশেও স্পষ্টত ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ এবং দারিদ্র্য বিমোচন ব্যাহত করেছে। তবে এখন একটি জোরালো বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আশা করি, প্রাক-মহামারী প্রবৃদ্ধির পথে ফিরতে রফতানি কৌশলে অভিনবত্ব আনার মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সুফল কাজে লাগাতে পারবে।

দুঃখজনকভাবে, একুশ শতকের শুরুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, যা সময়ান্তরে প্রয়োজনীয় বাণিজ্য নীতির সংস্কার ব্যাহত করেছিল। ১৯৯০-এর দশকের মতো চলতি শতকের প্রথম দিকে শুল্ক হ্রাস কিংবা অন্য বাণিজ্য সংস্কারে অধোগতি দেখা গিয়েছিল। এ দশকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মধ্যে ছিল নমনীয় থেকে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হারে (আসলে মেনেজড ফ্লোট) পদার্পণ। ২০০৪ সালে এটি চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এর সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা আমদানিতে পণ্যের পরিমাণগত নিষেধাজ্ঞা (কিউআর) চূড়ান্তভাবে প্রত্যাহার করে। শেষোক্ত উদ্যোগটি নেয়া হয় বস্ত্র আমদানিতে সর্বশেষ থাকা কিউআরের ওপর শুল্কায়নের একটি পরিমিত কর্মসূচির মাধ্যমে। একটি অর্ধ-শুল্ক (প্যারা-ট্যারিফ) আইডিআরসি (অবকাঠামো উন্নয়ন সারচার্জ) ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয় এবং সেটিকে কাস্টম ডিউটির সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। তবে এ অধ্যায় শেষ হতে না হতেই ২০১০ সালে আরেকটি অর্ধ-শুল্ক রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আরোপ করা হয়। এটা বলা ভালো, এর মধ্য দিয়েই শুল্ক সংস্কার অধ্যায়ের অবসান হয়েছে। রেগুলেটরি ডিউটি প্রতি বছরই নবায়ন করা হচ্ছে। এটি নিজেই একটা জীবন লাভ করেছে এবং দ্রুত এটি প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আরেকটি অর্ধশুল্ক সম্পূরক কর (সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি) আরোপ করা হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের ভ্যাট অ্যান্ড সাপ্লিমেন্টারি ডিউটিজ অ্যাক্টের অধীনে প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফলে এটি সুরক্ষাবাদের নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। পিআরআই পরিচালিত এক গবেষণায় আমরা দেখেছি দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য অধিকাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ডব্লিউটিও ২০১৯ সালে তার ট্রেড পলিসি রিভিউতে যেমনটা নিশ্চিত করেছে, শুল্ক এবং অর্ধ-শুল্কই হলো এখন বাংলাদেশে বাণিজ্য নীতির প্রধান হাতিয়ার।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি রফতানি প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতরে আমরা অবিবর্তন প্রক্রিয়ার (অসিফিকেশন) একটি অশুভ প্রবণতা দেখতে পাই, যা বাংলাদেশের শুল্ক কাঠামোকে ঘিরে রেখেছে। ১৯৯০-এর দশকে কমলেও গড় নামিক শুল্ক (এনপিআর) গত দুই দশকে অনেকটা বেড়েছে। ইনপুট শুল্ক কমেছে, উৎপাদন শুল্ক বেড়েছে। এটা শিল্পকে রফতানি অনুৎসাহিত করছে।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে রফতানি নৈপুণ্য এবং শুল্ক সুরক্ষা পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়। আমদানি প্রতিস্থাপন উৎপাদনের ওপর শুল্ক হলো পরোক্ষ ভর্তুকি, যা রফতানিকে অবমূল্যায়িত করে এবং রফতানিবিরোধী পক্ষপাত সৃষ্টি করে। বিশেষ বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সিস্টেমের কারণে ১০০ শতাংশ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত বাস্তবে একটি মুক্তবাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। কাজেই পোশাক-বহির্ভূত খাতগুলোর জন্যও সমরূপ সুযোগ প্রদানে ব্যাপকতর অভ্যন্তরীণ চাপ ছিল। বৈষম্যমূলক বাণিজ্য নীতির কারণে আপেক্ষিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পোশাক-বহির্ভূত পণ্যগুলো রফতানিতে কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি। মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে আসছে। অর্থাৎ আমাদের রফতানি খাত এখন একপণ্য নির্ভর। আরএমজি-বহির্ভূত পণ্যগুলো (যা শতভাগ রফতানিমুখী নয়—মানে এর উৎপাদকরা অভ্যন্তরীণ ও রফতানি বাজার দুটোই ধরতে পারে) অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত। এভাবে সুরক্ষা ব্যবস্থার রফতানিবিরোধী পক্ষপাতের কারণে রফতানি বৈচিত্র্য স্থবির রয়ে গেছে।

যতক্ষণ আমরা সনাতনী শুল্ক ব্যবস্থা এবং গতিশীল রফতানিমুখী অর্থনীতি উপযোগী আমাদের শুল্ক কাঠামো তৈরি করতে পারব না, ততক্ষণ আমাদের রফতানি বৈচিত্র্যের সুযোগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখা বৈচিত্র্যপূর্ণ রফতানিচালিত উৎপাদন খাত দিয়ে কভিড-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বেগবান করা সম্ভব হবে না। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫ অর্থবছর) ঠিক এ কৌশলের কথাই বলা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিশীলতার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের শুল্ক কাঠামোর যৌক্তিকীকরণ এবং আধুনিকায়নে বর্তমানে অনেকটা অগ্রগতি ঘটছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এ নিয়ে কাজ করছে।

২০২০-এর একটি বিপর্যয়ের বছরের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নিজেই এখন একটি ক্রসরোডে রয়েছে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো রফতানি চাঙা করা এবং আগামী তিন-পাঁচ বছর গড়ে বার্ষিক ৮ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এ চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে অনেক কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক সুবিধার (আইএসএম) অনেকগুলো হারিয়ে (যেটা আসলে এ পর্যন্ত আমাদের রফতানি খাতকে চাঙ্গা করেছিল) আমরা উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করব। এটা বলা ন্যায়সংগত হবে যে, ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে প্রথম প্রজন্মের বাণিজ্য সংস্কারগুলো করেছিল। ওই সংস্কারের সুফল বাংলাদেশ এখনো ভোগ করছে। তবে শুল্ক সংস্কার—বাণিজ্য নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাজটি এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ক্ষেত্রে অবিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া দেখা গেছে। শুল্ক কাঠামোর আধুনিকায়ন ছাড়া কি অর্থনীতি তার মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারবে? আমার অনেক লেখায় আমি যেমনটা বলেছি, বিদ্যমান শুল্ক ব্যবস্থা রফতানি বৈচিত্র্যায়নে (সরকারের উন্নয়ন এজেন্ডার অন্যতম অগ্রাধিকার) একটা বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।

দ্বিতীয় প্রজন্মের বাণিজ্য সংস্কারের অংশ হিসেবে দেশ যেহেতু বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে জোর দিচ্ছে, সেহেতু নব্বই দশকে শুরু হওয়া বাণিজ্য ও শুল্ক সংস্কারের অসমাপ্ত এজেন্ডা শেষ করা এবং সেগুলোকে একটি স্বাভাবিক পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়াটাই হবে একটি জাতীয় অগ্রাধিকার, যা ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পথে বাংলাদেশের জন্য প্রভূত সুফল দেবে। আমাদের আরএমজি উদ্যোক্তাদের নতুন প্রজন্ম এবং বস্ত্র ও অ্যাকসেসরিজ শিল্পে তাদের পশ্চাৎ সংযোগের অংশীদারদের ধন্যবাদ। তারা এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যবসাসংক্রান্ত মিডিয়া (যেমন- ব্লুমবার্গ নিউজ) থেকে বাংলাদেশ ‘দ্য নিউ এশিয়ান টাইগার’ অভিধা পেয়েছে, ১৯৬০-৭০-এর দশকে পূর্ব এশীয় বর্ঘ্র অর্থনীতিগুলোর (দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর) সমতুল্য। কল্পনা করুন, পোশাক-বহির্ভূত উৎপাদন খাতে অন্তির্নিহিত উচ্চ রফতানিবিরোধী পক্ষপাতনীতি এবং অনড় শুল্ক সুরক্ষানীতির অন্তরায় না থাকলে বাংলাদেশের রফতানি সফলতা আসলে কোথায় দাঁড়াত?

জাইদী সাত্তারচেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)

https://bonikbarta.net/home/news_description/273090/%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%87-%E0%A6%A6%E0%A6%B6%E0%A6%95-%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A3%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%97-

 

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Sattar is the Chairman and Chief Executive of Policy Research Institute of Bangladesh (PRI) since its founding in 2009. PRI is a leading think tank in Bangladesh. Dr. Sattar began his career in 1969 as member of the elite Civil Service of Pakistan (CSP), and later worked in the ...