মতামত_বিকল্প মুদ্রায় তেল কেনায় ঝুঁকি থাকবে

মতামত_বিকল্প মুদ্রায় তেল কেনায় ঝুঁকি থাকবে

 

ডলার–সংকটে বিকল্প মুদ্রায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার চিন্তাভাবনা চলছে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া এবং এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, যদি রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে আমরা অনেক বেশি তেল কিনতে পারি, তাহলে আমরা এগোতে পারি। সে ক্ষেত্রে খুব জটিল একটা পেমেন্ট সিস্টেম আমাদের বের করতে হবে। কেননা, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। আমরা যদি এখন রাশিয়া থেকে তেল কিনতে চাই, তাহলে সেটা সাধারণ লেনদেন হবে না। প্রশ্ন হলো, তেল কেনার অর্থ আমরা রাশিয়াকে পরিশোধ করব কী করে? এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে। এ চুক্তির আওতায় আমরা রাশিয়াকে বলতে পারি আমরা যদি এক বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করি, বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলারের তেল আমরা নেব।

রপ্তানিকারকদের সঙ্গে রপ্তানির বিষয়টা বন্দোবস্ত করতে গেলে আমাদের বিশেষ চুক্তি করতে হবে। কারণ, প্রত্যেক রপ্তানিকারক তো আলাদা। রপ্তানিকারকেরা ব্যাংক থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে আলাদাভাবে লেনদেন করেন। রাশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। রপ্তানিকারকদের পণ্য এক করে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা যে মূল্য পরিশোধ করবেন, সেটাও এক করে করতে হবে। তবে রপ্তানিকারকদের সহজে রাজি করানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের আশ্বস্ত করতে হবে, রাশিয়ায় পণ্য পাঠালে সরকার রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ ডলার তাদের দিয়ে দেবে। সেটা দিয়ে বাইরে থেকে তারা কাঁচামাল কিনতে পারবে।

প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকে সামগ্রিক আমদানি যদি আমাদের রপ্তানির চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আমাদের করণীয় কী? ধরা যাক, আমরা এক বিলিয়নের পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি করতে পারলাম। এর বিনিময়ে আমরা সমপরিমাণ তেল সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারব। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা বন্দোবস্তের মাধ্যমে সেটা করতে পারে। অতিরিক্ত অর্থের বন্দোবস্ত কীভাবে হবে, সেটাও আগে থেকে ভাবতে হবে। এমনও হতে পারে, আমরা অতিরিক্ত কিছু তেল নিয়ে রাখলাম, পরে সেটার মূল্য পরিশোধ করলাম। তবে এগুলো সবই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ ক্ষেত্রে একটা বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম প্রয়োজন হবে। রাশিয়া ও চীনের পেমেন্ট সিস্টেম আছে। আমরা সেখানে যুক্ত হতে পারলে এ ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আদায় করতে পারব। সেটার জন্যও আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন হবে। চীন ও রাশিয়া তাদের পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে আমাদের যুক্ত করবে কি না, তা কিন্তু তাদের বিষয়।

অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো রাশিয়া থেকে তো কম দামে তেল কিনছে। কিন্তু বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে হলে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে অন্তত নিমরাজি করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা যেন বাধা না দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বাংলাদেশ সংকটে আছে, দেশের মানুষ কষ্টে আছে। এ জন্য আমরা সস্তায় রাশিয়া থেকে তেল কিনতে চাই।

ডলার–সংকটে কারেন্সি সোয়াপের প্রসঙ্গ উঠেছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজি হলে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা বিনিময় কিংবা কারেন্সি সোয়াপ করা সম্ভব। বাস্তব রুবল বা বাস্তব টাকা দরকার নেই; কাগুজে রুবল বা কাগুজে টাকা হলেই সেটা হয়ে যাবে। ভারত ও চীন রাশিয়ার সঙ্গে এ ধরনের মুদ্রা বিনিময় করে অনেক পরিমাণ তেল আনতে পারছে। কারণ, তাদের বাণিজ্যে ভারসাম্য আছে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য কম, সে কারণে অনেক পরিমাণ তেল আমদানি করা সম্ভব নয়।

ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলারের। আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সে কারণে রুপি কিংবা রেনমিনবিতে বিনিময় করে আমরা খুব একটা লাভবান হতে পারব না। আর সেটা করতে গেলেও আমাদের বিকল্প পেমেন্ট ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকিও আছে। মনে রাখতে হবে, সুইফট সিস্টেমের মতো একটা নিরাপদ ব্যবস্থাকে কিন্তু হ্যাক করে আমাদের অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চীন কিংবা রাশিয়ার বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট থেকে দুর্বল। ফলে হ্যাকিং হলে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা আছে। সে জন্যই সতর্ক থাকা ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংক সে কারণে কারেন্সি সোয়াপ বা বিকল্প মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেকটা নিমরাজি। এ ক্ষেত্রে বুঝেসুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো রাশিয়া থেকে তো কম দামে তেল কিনছে। কিন্তু বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে হলে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে অন্তত নিমরাজি করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা যেন বাধা না দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বাংলাদেশ সংকটে আছে, দেশের মানুষ কষ্টে আছে। এ জন্য আমরা সস্তায় রাশিয়া থেকে তেল কিনতে চাই। সেটা খুব অল্প অঙ্কের বিষয়। তাদের বোঝাতে হবে, এতে কোনো প্রভাব পড়বে না। তোমরা এটাকে উপেক্ষা করো। মৌন সম্মতি দাও। পশ্চিমারা অন্তত নিমরাজি হলে আমাদের সেদিকে এগোনো উচিত। কিন্তু তারা যদি কঠোর মনোভাব দেখায় তাহলে সেদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। আমাদের রপ্তানির ৮০ শতাংশই পশ্চিমাদের সঙ্গে। সে ক্ষেত্রে বড় রকমের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। তাদের সঙ্গে নিয়েই কূটনৈতিকভাবে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে।

সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতির যে পরিস্থিতি, তাতে রাশিয়ার তেল আসুক কিংবা না আসুক, আমরা আমাদের সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম। বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন বেশ কমেছে। এখন ৯২ ডলারের কাছে। এটা যদি ৮৫ ডলারে নেমে আসে, তাহলে আমরা এখন যে দামে তেল বিক্রি করছি, সেখানে কোনো ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এখন সরকারকে ডলারের বিনিময় হারটা সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। ভারতে তেলের দামসহ এখন মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ। আমাদের এখানে তেলের দামের কারণে মূল্যস্ফীতি ৯-১০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেয়নি।

মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের মুদ্রানীতির ভূমিকা ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ, সুদহার নয়-ছয়ে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা সুদহার বাড়াতে পারছি না। এখন নয়-ছয় নীতিটাকে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করা। কিন্তু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের চাপে সুদহার ৯ শতাংশের ওপরে আমরা নিতে পারছি না। এটা খুবই অবাস্তব একটা বিষয়। নেতিবাচক সুদহার বড় করার কারণে টাকা সস্তা হয়ে যাচ্ছে, আকর্ষণ হারাচ্ছে। মানুষ ডলারের দিকে ঝুঁকছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্যই এখন প্রকৃত সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছালে তখন আবার নয়-ছয়ে ফিরে যাওয়া যেতে পারে।

  • আহসান এইচ মনসুর নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

https://www.prothomalo.com/opinion/column/12pzhcsz2b

 

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...