সাক্ষাৎকার: সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করতে হবে

সাক্ষাৎকার

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করতে হবে

ড. বজলুল হক খন্দকার

ডিসেম্বর ১৪, ২০২০

(গতকালের পর) 

আমাদের দেশে  সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ অপব্যবহার হয়। ফলে ইনক্লুশন প্রবলেম হচ্ছে। কী মডেল অনুসরণ করলে এটা দূর করা যায়?

এক্ষেত্রে ন্যাশনাল ডাটাবেজ একটি ভালো বিষয়। এটি আমাদের তথ্য দিচ্ছে। এর ভিত্তিতে আমরা পিন পয়েন্ট করতে পারব। তবে এটির মাধ্যমে কম লোককে টার্গেট করা হলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। এটি ব্যবহার করে আমরা যদি মোটামুটিভাবে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোককে টার্গেট করি, তাহলে আমরা ভালো একটি কাভারেজ পাব। এটি গেল একটি দিক। অধিকন্তু অনেকেই বলছেন, আমরা এখান থেকে যে একটি তালিকা তৈরি করব, সেটি কমিউনিটিকে দিয়ে দেব। বলব, তুমি কি মনে করো। এখানে কোনো ভুল আছে কিনা কিংবা ওপেন কমিউনিটির মধ্যে আলাপ করা। আমরা বলব, আপনাদের কমিউনিটি থেকে এতজন লোককে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এখানে আপনাদের কোনো মত আছে কিনা। এক্ষেত্রে হয়তো আমরা তিনটি মিটিং করতে পারি।

কিন্তু আমাদের কমিউনিটির  ধরনের অভিজ্ঞতা ভালো কিনা।

অনেক দেশে অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতে পারি। অনেকেই মনে করেন যে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হলে এটি ভালো হতে পারে। সেটি নির্ভর করবে ম্যাকানিজম কী হবে তার ওপর। পার্টিসিপেটরি ম্যাকানিজমে কোনো ইনফ্লুয়েন্স না থাকলে, আমরা যদি যারা যুক্ত তাদের দিয়ে না করে কোনো এনজিওকে দিয়ে করাই বা কোনো তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে করানো হয় তাহলে সুযোগ/ফলাফল ভালো হবে। সেখানে বলে দিতে পারি, ভুল হলে আপনারা দায়ী থাকবেন। আমরা তো জাতীয় পর্যায়ে একটা ডাটাবেজ পাব। তখন বুঝতে পারব ভ্যারিয়েশনটা কত বেশি। যেখানে ভ্যারিয়েশন ১০ শতাংশের বেশি হবে, সেখানে তাদের আমরা বলতে পারি যে আপনাদের অ্যাপ্রোচে ভুল ছিল। সুতরাং আপনাদের দ্বিতীয়বার কাজ করতে হবে।

আমরা সামাজিক নিরাপত্তার অধীনে যে অর্থ দিচ্ছি তা অপর্যাপ্ত। যেমন বয়স্ক ভাতাবিধবা ভাতা। এটিকে কীভাবে দেখেন?

এখন যা হচ্ছে, তা হলো মন্দের ভালো। কিছুই পাচ্ছে না, সেখানে কিছু পাওয়া ভালো। এটিকে আমরা সামাজিক সুরক্ষার ভাষায় বলি, জেনরোসিটি। ট্রান্সফারের পরিমাণ আমরা বলি। আমরা দেখেছি যে এ পরিমাণ অর্থ কম। দরিদ্ররা বলে যে এটি তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাহলে কী করা যেতে পারে? আমরা প্রথম থেকেই বলছি, যে পরিমাণ অর্থ দিচ্ছি, সেটাকে কাছাকাছি আনা যায় কিনা। এটি একটি অ্যাপ্রোচ হতে পারে। আমার একটি ভাবনা হলো, আমরা যদি চাইল্ড বেনিফিট ১ হাজার টাকা করতে পারি প্রথম সন্তানের জন্য, দ্বিতীয় সন্তানের জন্য সরকার ৫০০ টাকা দেবে। তাহলে ওই পরিবার দেড় হাজার টাকা পেয়ে যাচ্ছে। যেকোনো পরিবারে একজন বয়স্ক লোক থাকবেই। তাকে সরকার আরো ১ হাজার টাকা দেবে। তাহলে সে আড়াই হাজার টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি এটি করতে পারি, তাহলে একটি পরিবারের জন্য মোটামুটিভাবে রিজনেবল পরিমাণ অর্থ দিতে পারি প্রতি মাসে। এটি কিন্তু তাকে একটি ট্রানজিবল বেনিফিট দেবে। সেটি করলে কী হবে? এই পরিবার ওই প্রাপ্ত অর্থ থেকে শিশুদের স্কুলে পাঠাবে, পুষ্টিকর খাবার দেবে, কিছু সঞ্চয় করবে, সম্পদ বাড়াবে। তাহলে আমরা কী করতে পারি? আড়াই-তিন হাজার টাকা দিয়ে তিন-চারটি লক্ষ্য অর্জন করতে পারি। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত হবে, স্কুলে যাবে, তারা কিছুটা সঞ্চয় করবে, শিশুশ্রম কমবে, বাল্যবিবাহও কমতে পারে। একটি কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা এতগুলো সুবিধা পেলে ইন্টারভেনশনের বেনিফিটও অনেক বেশি হবে। পাঁচ বছর পরে আর দিতে হবে না। এ থেকে জাতি অনেক বেশি সুবিধা পাবে। কাজেই এটা করা উচিত।

আমাদের  কি ফান্ডের ঘাটতি আছে?

আমাদের ফান্ড নেই, সেটি আমরা বলব না। অপ্রিয় হলেও বলি, আমাদের যেসব অবকাঠামো প্রকল্প হচ্ছে, নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু সেগুলো আমরা কীভাবে সামলাচ্ছি, তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ছে। তার মানে অর্থ ব্যয়ে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। তাহলে, আমি যদি একটা প্রকল্প তিন বছরে শেষ করতে পারি, অনেক অর্থ সাশ্রয় হয়। আমাদের ফান্ডিং অল্প কিন্তু সেটিকে অকার্যকর-অদক্ষভাবে ব্যবহার করলে তার প্রভাব পড়ে স্কুল প্রোগ্রামে, হেলথ প্রোগ্রামে। এগুলো সফট সেক্টর। সোস্যাল প্রটেকশনে ইফেক্ট হচ্ছে। আমি আমার বেতন কমাতে পারব না। সরকারের বেতন দেয়া লাগবে। তারপর ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সম্পদের দক্ষ ব্যবহার হলে উল্লিখিত খাতে টাকা দিতে সহজ হবে। আমরা কীভাবে পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজ করব, সেটি বুঝতে হবে। পিএফএম বাংলাদেশে খুবই দুর্বল। ফলে এফেক্ট হচ্ছে স্কুল প্রোগ্রামগুলো, হেলথ প্রোগ্রামগুলো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো; যেগুলোর প্রধান উপকারভোগী গরিবরা। সামাজিক সুরক্ষার জন্য একটি সামগ্রিক অ্যাপ্রোচ (হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ) নিতে হবে।

আমরা বর্তমানে যা করছি তার প্রভাব আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এখন যা করছি তা হলো টোকেনিজম। আমরা সব প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে মাত্র তিনটি প্রোগ্রাম করি। এক. চাইল্ড বেনিফিট, দুই. স্কুলের প্রোগ্রাম আর তিন. ওল্ড এজ প্রোগ্রাম। তিনটি প্রোগ্রাম করে আমরা দেখি কত টাকা লাগছে। এখন আমরা কত টাকা খরচ করছি। এই প্রোগ্রামের জন্য আমাদের যদি জিডিপির ২ শতাংশ অর্থ খরচ হয়, তাহলে তা-ই করা উচিত, ৪১টি কর্মসূচি না করে। আমি এদের জন্য ইউনিভার্সেল প্রোগ্রাম করতে চাইছি, আমার কত খরচ হবে।

প্রথমে তিনটি কর্মসূচি পরিচালনা করি আগামী দশ বছরে। তারপর ধীরে ধীরে শিফট করি। কিছু জিনিস দরকার। নারীদের জন্য আমাদের সহায়তা দরকার। বাকি লোকদের জন্য আমাদের প্রকল্প দরকার নেই। এদের সুরক্ষার আওতায় আনতে পারলে পাঁচ-ছয়টি প্রোগ্রামে সবকিছু ভালোভাবে করতে পারি।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অপব্যবহার বা অদক্ষ ব্যবহার কীভাবে কমাবেন?

একটি হলো উপজেলা, জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে গ্রিভেন্স কমিটি দরকার। যেখানে লোকজন নির্ভয়ে যেন বলতে পারে আমার এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। দুই. তৃতীয় পক্ষের মনিটরিং দরকার। তিন. এখানে অডিটিং মনিটরিংগুলো জোরদার করতে হবে। এটা একদিনে হবে না। এ পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে করতে হবে এবং সরকারকে মেনে নিতে হবে আমি থার্ড পার্টি মনিটরিংকে উৎসাহিত করব। সেখানে তারা বলবে, কোনো এলাকায় প্রোগ্রামে ত্রুটি দেখা দিলে সেটি আমরা বন্ধ করে দেব। এখানে একটি রাজনৈতিক ভয় আছে যে আমার প্রোগ্রাম বন্ধ হলো কেন? এগুলোর জন্য থার্ড পার্টি মনিটরিং খুব দরকার। আপনি নিজেই বাস্তবায়ন করছেন, আবার আপনিই মনিটরিং করছেন, এটি হয় না। যেখানে দরকার আপনি নিজে করবেন, কিন্তু থার্ড পার্টি রেজাল্টবেজড মনিটরিং করবে—আমি এই টাকা দিয়ে এই রেজাল্ট পাচ্ছি। আমি পেয়েছি? পাইনি। আমি ফিজিক্যালি পরিদর্শনে গিয়ে টিক দিয়ে দিচ্ছি। আমরা এই টাকা খরচ করে যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছি, তা পারছি কিনা। সেটি না পারলে এ মনিটরিংয়ে তো লাভ নেই।

অনেকেই মনে করেন যে সরকারের চেয়ে এনজিওগুলোর দক্ষতাকার্যকারিতা অনেক বেশি। সেজন্য তারা চান যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো তাদের মাধ্যমে পরিচালনা করা হোক?

বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম তৈরি ও পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু সিস্টেমটা ডেভেলপ করেনি। সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচগুলোয় আমরা জোর দিইনি। ক্যাপাসিটি ডেভেলপ করেনি। তা না করে আমরা সরকারকে দোষ দিতে চাইছি না। এনজিওগুলো অনেক এক্সট্রিম পভার্টি প্রোগ্রাম বাংলাদেশে নিয়েছিল। চর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্প—এ প্রকল্পগুলো খুব সফল। কারণ তাদের প্রশাসনিক তদারকি খুব ভালো ছিল। তারা পরিদর্শন, তদারকি এসবের জন্য অনেক খরচ করেছে। কর্মসূচি শুরু করার আগে তারা এ কাজগুলো করেছিল। আমরা এসবে খরচ করি না। ধরে নিই যে আপনাআপনি হবে। কখনো আপনাআপনি হয় না। আমি মনে করি, এটি সরকারেরই করা উচিত। চূড়ান্তভাবে সরকারকেই করতে হবে। আমরা এনজিওকে ব্যবহার করতে পারি, করব এবং সেটি করব থার্ড পার্টি মনিটরিং করার জন্য। কিন্তু কর্মসূচি বাস্তবায়ন সরকারের হাতে থাকা উচিত। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সেভাবে ডেভেলপ করতে হবে।

আলাদা প্রতিষ্ঠান করার দরকার কী?

এনএসএসে আরেকটি বিষয় ছিল, সেটি হলো, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো কী হবে। সোস্যাল সিকিউরিটি যেহেতু ধীরে ধীরে বড় হবে, সেখানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য প্রোগ্রামগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত করে একটি ইনস্টিটিউটে দাঁড় করাতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এগুলো তদারক করবে। অনেক দেশেই কিন্তু এটি সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয়।

অনেকেই মনে করেন যে দারিদ্র্য শূন্য হলে সামাজিক সুরক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে তা নয়। বরং উল্টো হবে। কারণ রাষ্ট্র ধনী হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরো বাড়বে এবং জনগণের প্রত্যাশা আরো বাড়বে। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য আমরা কী করছি? আমরা বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দিচ্ছি। আমরা বলছি, আমাদের জিডিপির ৩২-৩৪ শতাংশ বিনিয়োগ লাগবে। একটা পর্যায়ে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো আর লাগবে না। সব বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আপনি কী করবেন? আপনাকে বিনিয়োগ থেকে পরিভোগে সুইচ করতে হবে। পরিভোগ বাড়ানোর সবচেয়ে বড় প্রোগ্রাম হলো সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম। এর জন্য ধীরে ধীরে দেশকে তৈরি করতে হবে। তা না হলে সুইচটা ভালো হবে না। এটি না পারলে প্রবৃদ্ধির হারে প্রভাব পড়বে। তখনও বিনিয়োগ হবে, মেইনটেন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট হবে ১০ শতাংশের মতো। আর বাকি ২০ শতাংশ আসতে হবে পরিভোগ থেকে। এজন্য একটি শক্তিশালী মন্ত্রণালয় প্রয়োজন। বর্তমানে এটি কারিগরিভাবে দরিদ্র্য, সম্পদেও দরিদ্র্য। এটিকে দ্রুত শক্তিশালী করতে হবে। (শেষ)

 

বজলুল হক খন্দকারঅধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

Dr. Bazlul Haque Khondker

Dr. Bazlul Haque Khondker

Dr. Bazlul Haque Khondker holds a PhD from the University of Warwick and is currently teaching at Dhaka University as a Professor of Economics. His areas of expertise include: (i) analysis of poverty and income distribution impacts of trade and tax policy reforms using static as well as dynamic Computable ...